বুধবার, ১ জুলাই, ২০১৫

জিমি (JIMMY)


জিমি (JIMMY)
১৯৬৭ সন। অনেক কাল আগের কথা।ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমাদের বাড়ীটি ছিল বাংলো প্যাটার্নের। দেখতে অতি চমতকার লাগতো। চারিদিকে দেয়াল ঘেরা একটি টিনের বাড়ী।
আমার চাচার ফুল গাছের সখ ছিল। তিনি বাড়ীর উঠোনে বেশ কিছু গোলাপের গাছ লাগিয়েছিলেন। এর মধ্যে হলুদ গোলাপ আর কালো গোলাপ ছিল। লাল গোলাপতো ছিলই! তিনি গাছের খুব যত্ন নিতেন। ফুলগুলো চমতকারভাবে ফুটে থাকতো। যার নজরেই পড়তো প্রশংসা না করে পারতো না। বাড়ীর সীমানা ঘিরে লাগানো হয়েছিল সুপারি গাছ ও কলা গাছ। গাছের কলা অনেক খেয়েছিলাম।
আমার বাবা আইনজীবি ছিলেন। আব্বা কোর্ট থেকে ফিরে বারান্দায় ইজি চেয়ার পেতে বসতেন। তিনি আত্মীয় পরিজন সবার কাছে শ্রদ্ধেয় ছিলেন। ছোট বড় সবাই তাঁকে ভালোবাসতো। আত্মীয় পরিজনদের আইন সংক্রান্ত কাজ বাবাই করতেন। আমাদের বাড়ীতে তাঁরা সব সময় আসা যাওয়া করতেন।
আমাদের পরিবারটি একটি রক্ষনশীল মুসলিম ঘর। বাড়ীতে কখনও কুকুর পোষা হতো না। দাদা বলতেন "কুকুর ইসলামে হারাম। বাসায় কুকুর থাকলে নামাজ হবে না।"
পুরানা পল্টনের বাড়ীটি আমার বাবা তৈরী করে ছিলেন। আমরা তৈরী করা বাড়ীতে উঠিনি। এটি ছিল ডোবা ভরাট করা একটি জমি। খালি জমিতে একটি কুকুর ছিল। বাবা কুকুরটিকে তাড়ানোর অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কারণ, দাদা কুকুর দখলে খুবই বিরক্ত হতেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো কুকুরটিকে শেষ পর্যন্ত তাড়ানো গেল না। দূরে কোথাও ছেড়ে দিলেও সে আবার আমাদের বাড়ীতে ফেরত আসতো। এক সময় বাবা ওকে তাড়ানোর কথা ভুলে গেলেন। ওর নাম দিলেন "জিমি"। ধীরে ধীরে জিমিকে তিনি ভালোবেসে ফেললেন।
বিকালে কোর্ট থেকে ফিরে এলে জিমি বাবার কাছে এসে আনন্দে লেজ নাড়তো। বাবা যা খেতেন জিমিকে তাই খেতে দিতেন। আমি দেখেছি জিমিকে তিনি বিস্কিট খাওয়াতেন।
একদিন সন্ধ্যায় আমার ঘরে বসে পড়ছিলাম। মশা কামড়াচ্ছিল বলে মাঝে মাঝে পা চুলকাচ্ছিলাম। এমন সময় জিমি আমার দরজার কাছে এসে অনবরত ঘেউঘেউ করতে লাগলো। আমি অবাক হলাম। কারণ, জিমি ঘেউ ঘেউ করতো অপরিচিত কাউকে দেখলে। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। কেবল মনে হলো সে আমাকে কিছু দেখাতে চাইছে। এ যেন ঠিক মানুষের মত। সে চোখ দিয়ে ঈশারা করে আমায় কিছু দেখাচ্ছিল। ওর চোখের ঈশারা অনুসরণ করে আমি এগিয়ে গেলাম। বারান্দার সিঁড়ির নীচে গিয়ে সে দাঁড়ালো। আমার ঘরের সামনের বারান্দায় তিন ধাপের একটি গোল সিঁড়ি ছিল। সিঁড়ির দ্বীতিয় ধাপে সাপটি সিঁড়ি জড়িয়ে ধরে ছিল। বারান্দায় হাঁটা চলার সময় সিঁড়ির এই অংশটুকু কেউ দেখতে পাবেনা। আমি খুব ভয় পেলাম। সাবধানে নীচে নামলাম। ঘাসে ভরা উঠোনে দাঁড়ালাম। বাড়ান্দার বিদ্যুত বাতিটি জ্বালিয়ে দিলাম। আমার গা শিউরে উঠলো। ছোট বেলা থেকেই আমি চ্যাল্লা, বিচ্ছু, ছ্যাঙা, টিকটিকি, পোকামাকড় ইত্যদি খুবই ভয় পাই। প্রাকৃতিক ভারসাম্যের কথা ভুলে গিয়ে ভাবি বিধাতা কেন সাপ আর চ্যাল্লা সৃষ্টি করলেন।
মনে হয় পাশের ডোবা থেকে সাপটি এসেছিল। আমাদের বাসার পশ্চিম পাশে বেশ বড় একটি ডোবা ছিল।এখন সেখানে বিশাল অট্টালিকার সারি। আমাদের বাসার ঘাসে ভরা উঠোন, বৃষ্টি হলে কিছুটা কাঁদা হতো। কিছুটা স্যাঁতস্যাঁতে লাগতো। মনে হয় এ জন্যই সাপটি বারান্দার সিঁড়ি পেঁচিয়ে ঘাপটি মেরে ছিল।
বাবা লোকজন ডেকে পাঠালেন। তারা লাঠিসোটা নিয়ে এসে সাপটি মারলো। জিমি আমার পাশে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখলো। সে প্রায়ই আমার ঘরের দরজার সামনে বসে থাকতো। শুয়ে থাকতো। কখনওবা ঘুমিয়ে থাকতো।
জানিনা জিমি কি করে বুঝেছিল যে সাপ বিপদজনক। আমাকে সাপটি দেখাতে হবে এটাই বা সে কেমন করে বুঝলো? আজো আমি এই ঘটনাটির কোন বৈঞ্জানিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাই না। কিন্তু এটি একটি সত্য ঘটনা। মনে হয় পশুকেও বোঝার ও জানার এখনও অনেক বাকী। পশুদেরও আছে আমাদের মত লাল রক্ত। আছে হৃতপিন্ড, ফুসফুস, লিভার ও কিডনী। তারাও ব্যাথা অনুভব করে। কখনও আবার বিষন্নও দেখা যায় তাদের। গরুর কালো চোখে আমি অনেক সময় বিষন্নতার ছায়া দেখেছি।
কুকুরের আয়ু মানুষের মত নয়। অনেক কম। এ মূহুর্ত্তে আমি ঠিক বলতে পারছি না, একটি কুকুর গড়ে ঠিক কতদিন বাঁচে।
কয়েক বছর পর জিমি হঠাত পাগল হয়ে গেল। একে ওকে কামড়াতে লাগলো। তখন আর জিমিকে আমাদের কুকুর বলা গেলনা। এটা সামাজিক সমস্যার আওতায় পড়ল। ততকালীন মিউনিসিপালিটি করপোরেশন একদিন আমাদের এলাকার সব পাগল কুকুর মেরে ফেলল। জিমি তাদের মধ্যে একটি। বাবা প্রচন্ড আঘাত পেয়েছিলেন। আমি তাকে জিমির জন্য কাঁদতে দেখেছি।
জিমিকে আমি এখনও ভাবি। হয়তো যতদিন বেঁচে থাকবো জিমিকে মনে রাখবো।